আলহাজ্ব মোহাম্মদ শাহ আলম : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা, শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারটিই একটি মানবিক পরিবার। যারা সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন এ জাতিকে। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, অসহায়ের প্রতি সংবেদনশীলতা শেখ পরিবারের ঐতিহ্য। তরুণ শেখ মুজিব নিজেদের ধানের গোলা থেকে প্রতিবেশী দরিদ্র অসহায়ের মধ্যে ধান বিতরণ করে দিয়েছিলেন।
ভিনদেশি রোহিঙ্গা নারী যখন তার নাড়িছেঁড়া ধন, আদরের নবজাতকের নাম রাখেন শেখ হাসিনা তখন সর্বস্ব হারিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া এমন মানুষরা শেখ হাসিনার মানবিকতায় কতটা বিমুগ্ধ আর অভিভূত এ উপলব্ধির জন্য চোখ বন্ধ করতে হয় না। শুধু বাঙালি নয়; বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের মনের গহিনে আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা আসন গেড়েছেন। তার আকাশসম বিশাল মানবিকতা, হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা আর মানবকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছেন মানবতার জননী এবং মহানুভব নেত্রী।
পিতা শেখ মুজিব যখন কলকাতায় ভারত ভাগের পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দাঙ্গা প্রতিরোধ এবং লেখাপড়া নিয়ে মহাব্যস্ত তখন ১৯৪৭ সালের এ দিন টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তার জন্ম হয়। গ্রামবাংলার কোমল মাটির স্পর্শ এবং সবুজ প্রকৃতির গন্ধ মেখে তার শৈশব কাটে। সেখানেই শিক্ষা জীবন শুরু হয়। এরপর মা ফজিলাতুন নেছা রেণুর ছায়াসঙ্গী হয়ে পিতার রাজনৈতিক জীবনকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখেন এবং নিজেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে একজন আদর্শময়ী হিসেবে গড়ে তোলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই আদরের নয়নমণি ছোট্ট ‘হাচুমণি’ মানবিকতা আর ন্যায়বোধ দিয়ে বাংলাদেশের প্রিয় নেত্রী হয়ে বিশ্বনেত্রীর মর্যাদায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ইডেন কলেজের ভিপি নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ইতিহাসে জায়গা করে নেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ঘোষণার পর এর সপক্ষে এটি ছিল প্রথম ম্যান্ডেট। সেদিন শেখ হাসিনা পরাজিত হলে ইতিহাস অন্যভাবেও লিপিবদ্ধ হতে পারত। বাবার আন্দোলন-সংগ্রামে মা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সঙ্গে আজকের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাও ছিলেন ছায়াসঙ্গীর মতো। একাত্তরে বন্দিদশায় জন্ম নেয়া সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় আজ আধুনিক বাংলাদেশ গড়ায় কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্বময় আলোকিত। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অটিজম বিশেষজ্ঞ।
স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে পুরো পরিবারকে হারিয়ে ’৭৫ থেকে ’৮১ পর্যন্ত এ ৬ বছর প্রবাসে কষ্টের জীবন কাটাতে হয়। অভিবাসী হন পরিবারের বেঁচে থাকা দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। সুদীর্ঘ ৬ বছর প্রবাসে আশ্রিত জীবন শেষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচত হয়ে বাংলার মাটিতে পা রাখেন জাতির জনকের কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সত্যি বলতে কী, স্বাধীনতার স্থপতিকে হারানো ভাগ্যহারা বাঙালির স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় শুরু হয় ১৭ মে ১৯৮১ সাল থেকে। মূলত এরপর থেকে তার নেতৃত্বে শুরু হয় গণতন্ত্রে ফেরার আন্দোলন। ক্যু-হত্যা-গুম-খুনের বিরুদ্ধে শুরু হয় মানবিকতার সংগ্রাম। ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে জনগণের মানবাধিকার নিশ্চিত করেন তিনি। নিকট অতীতে তার হাত দিয়ে সম্পন্ন হয় বেশিরভাগ চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচার, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি, বিনামূল্যে কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বই বিতরণ, উপবৃত্তির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রের অভাবনীয় সফলতা। ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের কারিগর শেখ হাসিনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের মানবিক রূপ। এ সময় বারবার তাকে প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ মদদে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা করা হয়। এত কিছুর পরও শেখ হাসিনাকে মানবতার সংগ্রাম থেকে ফেরানো যায়নি।
দেশরত্ন শেখ হাসিনা শুধু জাতীয় নেতাই নন, তিনি আজ তৃতীয় বিশ্বের একজন বিচক্ষণ বিশ্বনেতা হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছেন। মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, উদার, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও বিজ্ঞানমনস্ক জীবনদৃষ্টি তাকে করে তুলেছে এক আধুনিক, অগ্রসর রাষ্ট্রনায়ক। একবিংশ শতাব্দীর অভিযাত্রায় দিন বদল ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার কারিগর তিনি। সারা বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের ভরসাস্থল। বিশ্ব মানবতা যখন মুখ থুবড়ে পড়ছে, মানবতার ঝুলি হাতে শেখ হাসিনা তখন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন। তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর। শেখ হাসিনার ঘোর শত্রুরাও আজ তার মানবিকতার প্রশংসা করছেন।
সর্বশেষ বিশ্বের সব গণমাধ্যম শেখ হাসিনাকে বলেছে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’। ২০১৬ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী কলাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোষ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘বিশ্বমানবতার বিবেক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আরেক নোবেলজয়ী কৈলাস সত্যার্থী তাকে ‘বিশ্ব মানবতার আলোকবর্তিকা’ হিসেবে তুলনা করেছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান শেখ হাসিনাকে একজন ‘বিরল মানবতাবাদী নেতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এক বক্তৃতায় তার প্রশংসা করে বলেছেন, ‘বাবার মতোই বিশাল হৃদয় তার। সেখানে ভালোবাসার অভাব নেই।’ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা দেখিয়ে দিলেন বাঙালির হৃদয় কত বড়। তিনি বাঙালির গর্ব।’ গার্ডিয়ান পত্রিকায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে বিশাল মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন, তা সত্যিই বিরল। তিনি যে একজন হৃদয়বান রাষ্ট্রনায়ক তা তিনি আগেও প্রমাণ করেছেন, এবারও প্রমাণ করলেন।’ ইন্ডিয়া টুডে তাদের দীর্ঘ এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘শেখ হাসিনার হৃদয় বঙ্গোপসাগরের চেয়েও বিশাল। যেখানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ে কার্পণ্য নেই।’
আসলে শেখ হাসিনার হৃদয়ের গভীরতার সঙ্গে বঙ্গোপসাগর বা আটলান্টিকের গভীরতার তুলনা প্রতীকী। হৃদয়ের গভীরতা উপলব্ধি করতে হয় হৃদয় দিয়ে; এর পরিমাপ হয় না। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভূ-রাজনীতি, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে যিনি আশ্রয় দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন, খাবার দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেছেন, সেই শেখ হাসিনার হৃদয়ের গভীরতা উপলব্ধি করে বিদগ্ধজন প্রতীকী তুলনা করার চেষ্টা করেছেন। আসলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর তুলনা তিনি নিজেই। একসঙ্গে প্রায় ১০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার সাহস এর আগে আমাদের মতো আর কোনো ছোট আয়তনের ও অর্থনীতির কোনো দেশ দেখিয়েছে বলে জানা নেই। এর মধ্য দিয়ে সারা বিশ্ব দেখল মানবিকতা এমনও হতে পারে!
শুধু রোহিঙ্গাই নয়; মাতৃস্নেহের এমন অনেক বিরল দৃষ্টান্ত এর আগেও স্থাপন করেছেন তিনি। নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে নিঃস্ব-রিক্ত পিতৃমাতৃহীন রুনা আর রত্নাকে নিজ কন্যার মর্যাদা দিয়ে গণভবনে এনে বর্ণাঢ্য আয়োজনে বিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পরে আরও এক নিঃস্ব মেয়ে আসমাকেও কন্যাস্নেহে একই অনুষ্ঠানে বিয়ে দিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সব স্বপ্ন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া এ তিন মেয়ের বিয়ের জন্য শাড়ি, গহনা এবং জামাইদের পোশাক-আশাক আর সংসার সাজানোর আসবাবপত্রসহ সবকিছুর ব্যবস্থা করেন প্রধানমন্ত্রী তার ব্যক্তিগত আগ্রহে। প্রধানমন্ত্রীর মাতৃস্নেহের দীপ্তির মাঝে ওরা ফিরে পায় নিজের মা-বাবাকে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা, শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারটিই একটি মানবিক পরিবার। যারা সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন এ জাতিকে। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, অসহায়ের প্রতি সংবেদনশীলতা শেখ পরিবারের ঐতিহ্য। তরুণ শেখ মুজিব নিজেদের ধানের গোলা থেকে প্রতিবেশী দরিদ্র অসহায়ের মধ্যে ধান বিতরণ করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় সংগঠন চালানোর জন্য দলের কর্মীদের খরচ জোগাতে নিজের গহনা বিক্রি করে দিয়েছেন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। সেই বাবা-মায়েরই কন্যা শেখ হাসিনা।
১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট যখন ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ড ঘটানো হয় ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বাসভবনে, তখন শেখ হাসিনা তার ছোট বোন শেখ রেহানা অবস্থান করছিলেন লন্ডনে। এখান থেকে তারা অণুবিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ আলী মিয়ার কাছে জার্মানিতে যান। ড. ওয়াজেদ তখন জার্মানিতে গবেষণারত ছিলেন। দুই বোন এজন্য প্রাণে বেঁচে যান। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরে তারা দুই বোন পরিবারের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক এ বাড়িটি জনসাধারণের জন্য দান করে দেন। এ বাড়ি এখন বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম। একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হচ্ছে। এ ট্রাস্ট প্রায় দুই দশক ধরে মাধ্যমিক পর্যায় থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত গরিব-মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি দিয়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘ আন্দোলনের পর ক্ষমতায় এসেও তার মানবিকতার হাত আরও প্রশস্ত হয়। মাতৃত্বের মমতায় শেখ হাসিনা এতিম শিশুর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন, পরম শ্রদ্ধায় অশীতিপর বৃদ্ধাকে বুকে জড়িয়ে নিচ্ছেন তাদের দুঃখ-দুর্দশা শুনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন। অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় তুলে আনার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নিচ্ছেন, জাতীয় বাজেটে তাদের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখছেন, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, ঈদ-পার্বণে তাদের জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্দ, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমিহীন-আশ্রয়হীনের জন্য ঘর বানিয়ে দিচ্ছেন, কাজ দিচ্ছেন। কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকে দেশের দরিদ্র মানুষ হাতের নাগালে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে, বিনামূল্যে ওষুধও পাচ্ছে। প্রথমবার ক্ষমতায় এসে মূল বাজেটের বাইরে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ দিয়েছিলেন। তার এ সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সফল কর্মকান্ডের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্থা, আন্তর্জাতিক ফোরামে তিনি সম্মানিত এবং প্রশংসিত হয়েছেন, যা তিনি বাংলাদেশের জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছেন।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওপ্রথম বেলা সম্পাদক আলহাজ্ব মোহাম্মদ শাহ আলম
Leave a Reply