দৈনিক শিক্ষা নিউজ প্রতিবেদন : রাজধানীর হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী পারপিতা ফাইহা গত ২৪ আগস্ট আত্মহত্যা করে। অভিযোগ উঠেছে, তার প্রতিষ্ঠানের গণিতের শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়েনি বলে সে ফেল করেছে। সে ভীতি তার মধ্যে কাজ করছিল। পারিবারিক সমস্যার কারণেও সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে থাকতে পারে। অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, প্রাইভেট না পড়লে তারা শিক্ষার্থীদের নম্বর কম দেন। এমনকি যেসব শিক্ষার্থী শ্রেণি-শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে না, তাদের স্কুলে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
সরকার শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ করতে এবং আনন্দময় শিক্ষা নিশ্চিত করতে আগামী বছর পর্যায়ক্রমে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করতে যাচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষার বদলে শিখন-কার্যক্রমকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ শিক্ষাক্রম অনুসারে শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা।
নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা কম থাকলেও প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ হবে কি না সন্দিহান অভিভাবকরা। তারা বলেছেন, এখন একটি ক্লাসে অনেক শিক্ষার্থী থাকে। বড় বড় স্কুলে ৮০ থেকে ৯০ জনের জন্য একজন শিক্ষক থাকেন। আর ক্লাসের ব্যাপ্তিও হয় ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট। ফলে ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের পক্ষে পাঠ তেমনভাবে বোঝা সম্ভব হয় না। ফলে প্রাইভেট পড়তেই হয়। আবার শিক্ষকরা যেহেতু চাপ দেন, তাই তাদের কাছে প্রাইভেট পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা কমলেও পড়ালেখা তো থাকবেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতেও পরিবর্তন আসছে না। আবার শিক্ষকদের নম্বর দেওয়ার ক্ষমতা বাড়ছে। নতুন শিক্ষাক্রমেও শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট-কোচিং না করার উপায় থাকবে বলে মনে হয় না।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান দেশ গনমাধ্যমকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন মূল্যায়নে শিক্ষকদের হাতে নম্বর দেওয়ার ক্ষমতা পুরোপুরি থাকবে না। ধরা যাক, একটি শ্রেণির ৬ জনের একটা গ্রুপকে প্রজেক্ট করতে দেওয়া হলো। ২ জনকে বেশি নম্বর আর ৪ জনকে কম নম্বর দেওয়ার সুযোগ নেই। আর নম্বরের একটা অংশ (শিখনকালীন মূল্যায়নের) একজন শিক্ষার্থী আরেকজনকে দেবে। শিখনকালীন মূল্যায়নে শিক্ষকদের দায়িত্ব নিতে হবে। শিক্ষার্থী কম নম্বর পেলে তার জন্য শিক্ষার্থীকে নয়, শিক্ষককে জবাব দিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তদারকি বাড়াতে হবে। আমরা ইতিমধ্যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা কর্মকর্তা ও সুপারভাইজারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ডিসেম্বরে প্রশিক্ষণ পাবেন শিক্ষকরা। আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য লেখাপড়াটাকে আনন্দময় করতে চাই। যেভাবে আমরা পরিকল্পনা করেছি সেভাবে যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে আমার বিশ্বাস শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট-কোচিং পড়তে হবে না।’
সূত্র জানায়, আগামী বছর থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনো পরীক্ষায় বসতে হবে না। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ৬০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন ও ৪০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে। অন্যান্য বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন থাকবে। নবম ও দশম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ৫০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন ও ৫০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন থাকবে। অন্যান্য বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে।
অভিভাবকরা বলছেন, শিখনকালীন মূল্যায়নের নম্বর দেওয়ার দায়িত্ব যেভাবেই হোক শিক্ষকদের হাতেই থাকবে। শিক্ষকদের নৈতিকতা বা মানসিকতার যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের হয়রান করার সুযোগ থাকবেই। এক্ষেত্রে শ্রেণি-শিক্ষকের কাছে যারা প্রাইভেট পড়বে, তারা স্বাভাবিকভাবে শিখনকালীন মূল্যায়নে বেশি নম্বর পাবে। তাই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ গনমাধ্যমকে বলেন, ‘একটা ক্লাসে কেন ৮০ জন শিক্ষার্থী থাকবে? তাহলে একজন শিক্ষকের পক্ষে ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের ক্লাসে কিছুই করা সম্ভব নয়। আমরা বারবারই বলছি, একটি পিরিয়ড কমপক্ষে এক ঘণ্টা করার এবং ক্লাসে শিক্ষার্থী সংখ্যা সীমিত রাখার। কোচিং-প্রাইভেট বন্ধে নীতিমালা আছে, শিক্ষানীতিতেও এ ব্যাপারে বলা আছে। কিন্তু শিক্ষা আইন না হওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও তেমনভাবে শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না। ফলে প্রাইভেট-কোচিং কমছে না। নতুন শিক্ষাক্রমে এ বিষয়গুলো গভীরভাবে ভাবতে হবে।’
স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের প্রাইভেট-কোচিং বন্ধে সরকার ২০১২ সালে কোচিংবাণিজ্য বন্ধ বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন করে। তাতে বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন যদিও। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে ছাত্রছাত্রীর তালিকা, রোল, নাম ও শ্রেণি উল্লেখ করে জানাতে হবে। অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানপ্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
নীতিমালার বাইরে গিয়ে কোনো শিক্ষক কোচিংবাণিজ্যে জড়িত হলে তার এমপিও স্থগিত বা বাতিল, বেতনভাতা স্থগিত, বার্ষিক বেতনবৃদ্ধি স্থগিত, বেতন একধাপ অবনমিতকরণ, সাময়িক বরখাস্ত, চূড়ান্ত বরখাস্ত প্রভৃতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। কোচিংবাণিজ্যে জড়িত শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে সরকার পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়াসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পাঠদানের অনুমতি, স্বীকৃতি ও অধিভুক্তি বাতিল করতে পারবে।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্কুল ঘুরে দেখা যায়, ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের শিক্ষকরা সিদ্ধেশ্বরী ও শান্তিনগর এলাকায় প্রাইভেট পড়াচ্ছেন। আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিলের শিক্ষকরা শাহজাহানপুর ও খিলগাঁওয়ে কোচিং সেন্টার খুলে বসেছেন। দক্ষিণ শাহজাহানপুরের শিল্পী হোটেলের গলি, বেনজির বাগানে কোচিং সেন্টার বেশি। মনিপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পূর্ব মনিপুর এলাকায় প্রাইভেট-কোচিং করান। রাজধানীর মিরপুর ১৪-তে পুলিশ স্মৃতি স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং ইব্রাহীমপুরে মনিপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শাখা থাকায় ইব্রাহীমপুর ব্যাটালিয়ান বৌবাজার এলাকাজুড়ে শিক্ষকরা নিজ স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ান। প্রত্যেক স্কুল-কলেজের আশপাশের এলাকায় নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ান শিক্ষকরা। স্কুলে ঢুকে কোনোরকমে ক্লাস নিয়ে বাকি সময় প্রাইভেট-কোচিংয়ের পেছনে ব্যয় করেন তারা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কোচিং বাণিজ্য বন্ধে কড়া নীতিমালা থাকলেও এর বাস্তব প্রয়োগের প্রমাণ নেই। ফলে শিক্ষকরা ইচ্ছেমতো প্রাইভেট-কোচিং করাচ্ছেন। এমনকি ক্লাসে প্রকাশ্যেই তারা শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন। যারা প্রাইভেট পড়তে চাচ্ছে না, তাদের নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। পরীক্ষায় নম্বরও কম দেওয়া হচ্ছে কখনো।
Leave a Reply