পুলিশের রাতের ডিউটির ফাঁকি ধরতে মাঠে নেমেছে ডিএমপির (ঢাকা মহানগর পুলিশ) বিশেষ টিম। কমিশনারের ‘নাইট পার্টি’ নামে পরিচিত টিমের সদস্যরা রাজধানীর রাস্তায় ঘুরছেন মধ্য রাত থেকে ভোর পর্যন্ত। এ সময় ডিউটি পোস্টে অনিয়ম পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এমনকি সরেজমিন রিপোর্ট চলে যাচ্ছে ডিএমপি কমিশনারের মোবাইল ফোনে।
সূত্র জানায়, ১ আগস্ট থেকে এই বিশেষ টিমের সদস্যরা মাঠে থাকছেন। এজন্য ৩১টি টিম গঠন করা হয়। ৩১ জুলাই ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক স্বাক্ষরিত এক আদেশে এই বিশেষ তদারক টিম গঠন করা হয়। এতে বলা হয়, ‘প্রতিদিন দিবাগত রাত ১টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত তদারক টিমের সদস্যরা রাত্রিকালীন ফুট প্যাট্রোল, মোবাইল প্যাট্রোল ও চেকপোস্ট কার্যক্রম সরেজমিন তদারকি করবেন।’ তদারককারী অফিসাররা কোনো গার্ড/পিকেট/চেকপোস্ট/টহল দলকে তার দায়িত্বাধীন সময়ে একাধিকবার পরিদর্শন করতে পারবেন। ডিউটি তদারককালীন সময়ে প্রতি ঘণ্টায় কমপক্ষে একটি পরিদর্শনজনিত মন্তব্য লিপিবদ্ধ করতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি টিমে একজন উপকমিশনারের নেতৃত্বে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার ৮ জন সদস্য রয়েছেন। রোস্টার অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে তাদের দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে।
বিশেষ টিমের একজন উপকমিশনার যুগান্তরকে বলেন, নাইট ডিউটিতে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের অনেকেই গা ছাড়া ভাব নিয়ে ডিউটি করেন। কেউ কেউ সময়টা ঘুমিয়ে কাটান। কিন্তু তদারক টিমের কারণে এখন ঢাকায় পুলিশ সার্বক্ষণিক জাগ্রত। এছাড়া তদারকিতে পুলিশের নানাবিধ অসংগতি ধরা পড়ছে। সম্প্রতি রাত পৌনে ২টায় তেজগাঁও থানায় ঢুকে দেখা যায় হাজতখানায় ১২ জন আসামি রয়েছে। কিন্তু থানার রেকর্ডে মাত্র একজন আসামির উল্লেখ পাওয়া যায়। তাৎক্ষণিক বিষয়টি থানায় দায়িত্বরতদের কাছে জানতে চাওয়া হলে কেউ সদুত্তর দিতে পারেননি। পরে খিলক্ষেত থানায় গিয়েও অনিয়ম পাওয়া যায়। থানা চত্বরে ঢোকার মুখে সেন্ট্রি ডিউটি অনুপস্থিত দেখা যায়। পরে তদারক টিমের এক সদস্য থানায় ঢুকে ওসির কক্ষে প্রবেশ করেন। এ সময় তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে থানা পুলিশের কয়েকজন সদস্য হাজির হন। থানার অরক্ষিত অবস্থা সম্পর্কে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। বলা হয়, এমন পরিস্থিতিতে অসৎ উদ্দেশ্যে যে কেউ থানায় প্রবেশ করতে পারে। এমনকি ফাঁকা পেয়ে ঢুকে পড়তে পারে জঙ্গি বা সন্ত্রাসীরা। এ সময় সবাইকে সতর্ক থেকে ডিউটি করতে বলা হয়।
বিশেষ টিমের এক সহকারী কমিশনার যুগান্তরকে বলেন, রাস্তায় দায়িত্বপালনরত কয়েকটি প্যাট্রোল টিমকে ঘুমন্ত অবস্থায় পান তিনি। এ সময় তাদের ছবি তুলে রাখা হয়। এছাড়া হাতিরঝিল এলাকায় ডিউটি পোস্টে থাকলেও উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের মোবাইল ফোনে ব্যস্ত পাওয়া যায়। তাদেরও ছবি তোলা হয়। তদারক টিমের অপর এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, কয়েকটি থানায় গভীর রাতেও দর্শনার্থী পাওয়া যায়। সেখানে ওসিরা ছিলেন দেন-দরবারে ব্যস্ত। এত রাতে থানায় উপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে তড়িঘড়ি ওসির কক্ষ ত্যাগ করেন দর্শনার্থীরা। তদারক টিমের সদস্যরা দায়িত্বরত সবাইকে সতর্ক করেন।
তদারক টিমের এক উপকমিশনার যুগান্তরকে বলেন, তিনি মনে করেন থানার ওসিদের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। বিশেষ করে গভীর রাত পর্যন্ত তাদের থানায় ডিউটির রেওয়াজ বদলানো দরকার। তার প্রস্তাব হচ্ছে, সর্বোচ্চ রাত ৮টা পর্যন্ত ওসিরা থানায় থাকবেন। এরপর তিনি বাসায় গিয়ে পরিবারকে সময় দেবেন। সকাল ৯টার মধ্যে থানায় উপস্থিত হবেন। কিন্তু বর্তমানে সকালে থানায় গেলে ওসিদের পাওয়া অসম্ভব। কেউ কেউ দুপুরের পর থানায় যান। থাকেন মধ্য রাত পর্যন্ত। এতে তাদের অপরাধ-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ে। মঙ্গলবার রাত ১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, রাত্রিকালীন ডিউটিতে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা আছেন কমিশনারের নাইট পার্টি আতঙ্কে। রাত ২টায় মৌচাকে ফরচুন শপিংমলের সামনে একদল পুলিশ সদস্যকে ‘সাবধান’ অবস্থায় দেখা যায়। তাদের সামনে দাঁড়ানো একটি পিকআপ ভ্যান। সেখানে বসা একজন কর্মকর্তা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন। ভ্যান চলে যাওয়ার পরপরই পুলিশ সদস্যরা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়েন। ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে দায়িত্বরত এসআই উজ্জ্বল বলেন, কমিশনারের নাইট পার্টির রাউন্ড চলছে। ডিউটি পোস্ট দেখতে এসেছিলেন স্যার।
রাত পৌনে ৩টা। কাওরান বাজার হোসেন প্লাজার সামনে দাঁড়ানো পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান (নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঠ ১৪৪৩৫২)। ফাঁকা গাড়িতে তখন গভীর ঘুমে চালক নাজমুল। আশপাশে খুঁজেও দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের পাওয়া গেল না। তবে যথারীতি শাক-সবজিবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি চলছে। লাঠি হাতে সক্রিয় পুলিশের কথিত লাইনম্যানরা। রাস্তায় ট্রাক থামলেই টাকা আদায় করছেন তারা।
রাত সাড়ে ৩টা। গুলশান শ্যুটিং ক্লাবের বিপরীতে সক্রিয় চেকপোস্ট। এএসআই শরিফুলের নেতৃত্বে যানবাহন তল্লাশি করছেন ৩ জন পুলিশ সদস্য। গভীর রাতেও চোকপোস্ট ডিউটি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শরিফুল বলেন, কমিশনারের ‘নাইট পার্টি’ যে কোনো সময় আসতে পারে। তাই তারা সজাগ।
রাত ৩টা ৫০ মিনিট। বনানী ১১ নম্বর ব্রিজ। দু’যুবককে জেরা করছে পুলিশ। দায়িত্বরত এএসআই হেলাল তাদের গন্তব্য জানতে চান। যুবকরা বলছেন, তারা শহর ঘুরতে বেরিয়েছেন। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট নয় পুলিশ। এভাবে গভীর রাতে উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরলে আটকের বিধান আছে আইনে। কিন্তু যুবকরাও নাছোড়বান্দা। তারা এমন আইন মানতে নারাজ। এ নিয়ে চলছে বচসা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাত্রিকালীন পরিদর্শনকালে তদারক টিমের সামনে কোনো অসঙ্গতি ধরা পড়লে তৎক্ষণাৎ জানানোর নির্দেশ রয়েছে। প্রয়োজনে ছবি তুলে পাঠাতে বলা হয়েছে।
এমনকি তদারকিতে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারাও যাতে ফাঁকি দিতে না পারেন সেজন্য তদারক কর্মকর্তাদের পরিদর্শনকালীন সেলফি বা ঘটনাস্থল থেকে ছবি তুলে পাঠাতে বলা হয়েছে।
বিশেষ তদারক টিমের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন বুধবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা মানুষকে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা দিতে চাই। এটা আমাদের প্রচেষ্টা। কিন্তু পুলিশও তো মানুষ। এ কারণে হয়তো অনেক সময় তাদের শৈথিল্য চলে আসে। শেষ রাতের দিকে কেউ কেউ হয়তো ঘুমিয়ে পড়ে। রাত্রিকালীন ডিউটিতে অনিয়ম পেলে তদারক টিম রিপোর্ট দিচ্ছে। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
Leave a Reply