ঢেঁকি শিল্প গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এক সময় গ্রাম গঞ্জসহ সর্বত্র ধান ভাঙা, চাল তৈরি, গুঁড়ি কোটা, চিড়া তৈরি, মশলাপাতি ভাঙনোসহ বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি। কিন্তু বর্তমান যান্ত্রিক ও আধুনিক যুগে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলাসহ সারাদেশেই বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ ঢেঁকি শিল্প।
বর্তমান যান্ত্রিক যুগ। প্রগতি ও আধুনিকতার যুগ। কর্মব্যস্ত মানুষের ব্যস্ততা যেমন বেড়েছে তেমনি যেকোনো কাজ স্বল্প সময়ে স্বল্প শ্রমে দ্রুত সম্পন্ন করতে পারলেই মানুষ হাফ ছেড়ে বাঁচে। আধুনিক ও নতুন নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ অতীতের ঐতিহ্যবাহী অনেক অনেক জিনিসপত্রের ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে। চিরায়ত বাংলার হারিয়ে যাওয়া সেই ইতিহাস ঐতিহ্যেরই একটি অংশ হচ্ছে অতীতের বহুল ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় ঢেঁকির ব্যবহার। বছর দশেক আগেও এ উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ধান ভাঙা ও চাল ভাঙাতে ঢেঁকি ব্যবহার করতো গ্রামীণ নারীরা।
উপজেলার সাহেবের চর গ্রামের মাহফুজ রাজা জানান, আমাদের রান্না ঘরে এখনও একটি ঢেঁকি আছে। দীর্ঘদিন ধরে এটি ব্যবহার করা হয় না। সহজেই এখন ধানভাঙার মেশিনে ধান ভাঙা যাও, চালও ভাঙা যায় তাই এটি কষ্ট করে আর কেউ ব্যবহার করে না।
আড়াইবাড়িয়া গ্রামের ইমরান জানান, ঢেঁকি আমাদের গ্রাম বাংলার বিলুপ্ত একটি শিল্প৷ বর্তমানে ঢেঁকি নেই বললেই চলে। ছোটবেলায় দেখতাম ঢেঁকিতে চালের গুঁড়া করা হতো।
ধূলজুরী গ্রামের আশরাফুল ইসলাম রাব্বি বলেন,আমাদের বাড়িতেও ঢেঁকি ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটি রান্নাঘরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সহজে ধান, চাল ভাঙা যায় তাই কষ্ট করে এটি কেউ আর ব্যবহার করে না।
জানা যায়, ঢেঁকি চালাতে সাধারণত দুজন লোকের প্রয়োজন হয়। গ্রামে সাধারনত নারীরাই চালাতেন তাদের সাধের ঢেঁকি। একজন ছিয়া সংযুক্ত যা বড় কাটের সঙ্গে লাগানো থাকে তার এক প্রান্তে উঠে যার পাশে হাত দিয়ে ধরার নির্দিষ্ট খুঁটি ও লটকন থাকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে পা দিয়ে চাপ দিতে হয় আবার ছাড়তে হয়। অপরজন নির্দিষ্ট গর্তে যেখানে ছিয়ার আঘাতে চাল থেকে ধান বের হয় সেখানে সতর্কতার সঙ্গে ধান দিতে হয় আবার প্রতি আঘাতের পর পর ধান নড়াচড়া করে উল্টে পাল্টে দিতে হয় যাতে সবগুলোতে আঘাত লাগে। শেষ হলে বা গর্ত পরিপূর্ণ হয়ে গেলে এগুলো তুলে আবার নতুন ধান দিতে হয়।
দেশে রাইসমিল বা যান্ত্রিক কল বা মেশিন এর প্রচলন শুরু হয়। তখন থেকেই ঢেঁকির প্রয়োজনীয়তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। এক সময় গ্রামে গঞ্জে একটার পর একটা উৎসব লেগেই থাকতো। এসব উৎসবে পিঠা পায়েস সন্দেশ ইত্যাদি তৈরির ধুম পড়ে যেত। আর এসব তৈরির মূল উপকরণ হচ্ছে চালের গুঁড়ি। চালের গুঁড়ি তৈরির জন্য অতীতে ঢেঁকি আশ্রয় নেয়া হতো। ঈদ বা উৎসবের সময় ঘনীভূত হয়ে এলে প্রত্যেক বাড়িতেই ঢেঁকির ছন্দময় শব্দ শুনেই আন্দাজ করা যেত ঈদ বা উৎসব এসেছে।
এ ব্যাপারে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জামাল উদ্দিন জানান, ঢেঁকিতে ভাঙানো ঢেঁকিছাটা চালের কদর এখনও কমেনি।এ চালের ভাতের মজাই আলাদা। ঢেঁকিছাটা চালের ওপরের আবরণ থাকে যাতে প্রচুর পরিমান ভিটামিন রয়েছে। তিনি আরো বলেন, এ শিল্পকে রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব।